বিসিএস ভাইভায় ভালো করার উপায়
বিসিএস ভাইভাতে ২০০ নম্বর। আপনি যদি বেশিরভাগ প্রার্থীদের থেকে ৩০-৪০ বেশি পান তাহলে আপনার লাইফ চেইঞ্জ হয়ে যেতে পারে। কিছু ঘটনা বলি।
১. ৩৭তম বিসিএস এর ভাইভার সময় আমার এক ফ্রেন্ডকে বলা হয় মুজিবের বইয়ের নাম বল। ও বলে ম্যাডাম, মুজিব বলা তো ঠিক না, বঙ্গবন্ধু বলা উচিত। কপাল গুণে বেঁচে গেলেও ৩৮ এর ভাইভায় ফেল করেছে।
২. বোর্ড যা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে সবই পারছে। এক সময় একটা প্রশ্নের উত্তরে বলে it is a very good question। ফলাফল ভাইভা ফেল।
আপনার নাকে হাত দেওয়ার অভ্যাস থাকলে ভাইভা বোর্ডে কখন করবেন আপনি নিজেও জানবেন না। এত প্রস্তুতি নেওয়ার পরও আমি নিজেও একবার করেছিলাম।
বিসিএস ভাইভা পরীক্ষায় দুনিয়ার যেকোন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করতেই পারে তাই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে যাবেন? মোটেই না। শাকিব খানের ছেলে-মেয়ের সংখ্যা কয়টি এটা নিয়ে প্রস্তুতি না নিলেও হবে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ছেলে-মেয়ে কয়টি এটা কিন্তু পারতেই হবে। মূল কথা প্রায়োরটি অনুযায়ী শিখতে হবে; বিসিএস ভাইভা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে। কয়টি মুল বিষয় আপনাকে জানতেই হবে, পারতেই হবে, না পারলে খুবই দৃষ্টিকটু লাগে। ভাইভায় আপনি ফেল করতে পারেন। নিচে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা টপিকগুলো তুলে ধরলাম যেগুলো আপনাকে সবার আগে সর্বোচ্চ গুরুত্বসহকারে পড়তে হবে। চলুন শুরু করি।
#সবার আগে নিজেকে জানুন know thyself
ভাইভায় ভালো করার জন্য আপনি দুনিয়ার সব কিছু শিখে গেলেন কিন্ত নিজের সম্পর্কে যদি না জানেন তাহলে কিন্তু একদম সবর্নাশ হয়ে যেতে পারে। নিজের নামের অর্থ, এই নামে বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি থাকলে তাকে নিয়ে জানুন। আপনার জেলা, জেলার বিখ্যাত ও কুখ্যাত ব্যক্তি, নদী, স্থাপনা ইত্যাদি নিয়ে জানুন। আপনার জেলা কেন বিখ্যাত? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আপনাকে পারতেই হবে। জেলার ব্রান্ডিং করার সময় ছোট-খাট জিনিসের বদলে বড় জিনিসগুলো (যেমন মুক্তিযুদ্ধ) তুলে ধরুন। যেমন আপনার জেলা টাঙ্গাইল হলে মিষ্টি, শাড়ি এসব দিয়ে শুরু করার চেয়ে বরং মাওলানা ভাসানী, কাদের সিদ্দিকী, শামসুল হক ইত্যাদি বিষয়গুলো আগে তুলে ধরুন। মিষ্টি, শাড়ি শেষ দিকে বলুন । আশা করি বুঝাতে পেরেছি।
শুধু জেলা নয় বরং উপজেলা নিয়েও জানুন। আপনার জেলায় উপজেলা কয়টি, থানা কয়টি জানুন। আর এসব জিনিস বাংলা ইংরেজি দুই ভার্শনেই নোট করে প্রস্তুতি নিন।
আপনি যেই বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন করা হবে সেটা আশা করুন। তাই পঠিত বিষয়ের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখুন। বাংলাদেশে আপনার বিষয়ের প্রয়োগ হচ্ছে কি না বা আরও ভালোভাবে কীভাবে প্রয়োগ হতে পারে সেভাবে প্রস্তুতি নিন।
আর আপনি চাকরিজীবী হলে আপনার দায়িত্ব, প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত ইত্যাদি তথ্য আগে থেকেই জেনে রাখুন।
কারও কাছে মক ভাইভা দিন। কেউ না থাকলে নিজে নিজে প্র্যাকটিস করুন। মক ভাইভা সুপার ইফেক্টিভ। চাইলে কোচিং সেন্টারে শুধু মক ভাইভা দিন তবে কম নম্বর পেলে মোটেও হতাশ হওয়া যাবে না।
#কিছু প্রশ্নের উত্তর আগে থেকেই সাজিয়ে রাখুন
আপনি কেন সরকারি চাকরি করতে চান? কেন বিসিএস ক্যাডার হতে চান? আপনার পরিচয় বা introduce yourself এই প্রশ্নের উত্তরগুলো বিশেষ করে নিজের পরিচয় ইংরেজিতে বারবার প্র্যাকটিস করুন যাতে ভাইভা বোর্ডে আপনার fluency দেখে মনে করে আপনি ইংরেজিতে ভালো। তাহলে আপনার পরের প্রশ্নগুলো বাংলাতে হতে পারে।
মনে রাখবেন উত্তরগুলো গাইড থেকে কপি পেস্ট করবেন না। নিজের কথাগুলো বলুন। যারা ভাইভা নিয়ে থাকেন তারা কপি-পেস্ট উত্তর শুনে শুনে ত্যক্ত, বিরক্ত। তোতা পাখি আইন্সটাইনের সূত্র বলতে পারলেই কিন্তু সে আইন্সটাইন হয়ে যায় না। কপি-পেস্ট যতই হাই কোয়ালিটি জিনিসের হোক সেটা কপি পেস্ট। বঙ্গবন্ধুকে কারা হত্যা করেছেন? এটা হয়ত গাইডগুলোতে বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা বা এমন কিছু আছে সবাই যদি একই কথা বলে তাহলে আপনি ভাইভা বোর্ডে থাকলে আপনার কেমন লাগবে নিজেকে প্রশ্ন করুন। আমি হলে অন্য শব্দ ব্যবহার করতাম যেই শব্দ বঙ্গবন্ধু জীবিত অবস্থায় বলে গেছেন। নিজের সৃজনশীলতা প্রমাণের সেরা জায়গা ভাইভা বোর্ড। ২০০ নম্বর ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিতে পারে আপনার জীবনে।
#ভাইভা বোর্ডকে কন্ট্রোল করুন আপনি
প্লেটে ততটুক খাবার নিতে হয়, যতটুক খাওয়া যায় তাই ভাইভা বোর্ডে এমন শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করবেন না যেটা নিয়ে আপনার ধারণা নেই বা খুব কম আছে। আপনি যেসব শব্দ ব্যবহার করেছেন সেটা দিয়েই নতুন প্রশ্ন করা হতে পারে। যদি না পারেন তাহলে আপনার জ্ঞানের গভীরতা কম এটা ভাবাটাই স্বাভাবিক। আর যদি পারেন, তাহলে পজিটিভ ধারণা হবে। তাই যে বিষয়ে আপনার পাণ্ডিত্য আছে সে শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করার ট্রাই করুন। এরকম করতে পারলে ভাইভা বোর্ড আপনাকে কন্ট্রোল করবে না বরং আপনি ভাইভা বোর্ডকে কন্ট্রোল করবেন! এটা একদিনে হবে না। অনুশীলন, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, ইত্যাদি আবশ্যক।
# বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করুন
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে বিস্তারিত জানুন; বিস্তারিত মানে আসলেই বিস্তারিত। পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টামন্ডলী নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা রাখুন। গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়কদের নিয়েও জানুন। আলোচিত শহীদদের নাম ও কিছুটা বিস্তারিত জানুন। যেমন আবু সাঈদ ও মুগ্ধদের নিয়ে জানুন।
# ১৯৭২-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত শাসনকাল নিয়ে ভালভাবে জানুন
আপনি সরকারি চাকরি করতে আগ্রহী তাই ভেবে চিন্তে ভাইভা বোর্ডে উত্তর দিতে হবে। আশা করি বুঝাতে পেরেছি।
#বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা যেন মিস না হয় (এটা এখন আগের মতো গুরুত্ব বহন করে না)
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন বইগুলো পড়ুন। বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে ভালোভাবে পড়ুন। শেখা হাসিনার জীবন নিয়েও পড়ুন। তাদের পরিবার নিয়ে জানুন। মনে রাখবেন, বঙ্গবন্ধুর প্রথম সন্তান শেখ কামাল বা শেখ জামাল নয় বরং শেখ হাসিনা। সন্তান মানেই ছেলে নয়।
#সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখুন(ক্ষমতাসীন সরকার বেশি গুরুত্বপূর্ণ)
রূপকল্প ২০২১, ২০৪১, শেখ হাসিনার ১০টি উদ্যোগ, এসডিজি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যেন বাদ না যায়। মনে রাখবেন vision এর বাংলা হচ্ছে রূপকল্প। মানসিক চাপে এটা অনেকেই ভুলে যায়।
# মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়ালেখা করুন
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পরার শেষ নেই। যতটুকু পারা যায় পড়ুন। রিটেনের সব পড়ুন। প্রফেসর’স এর মুক্তিযুদ্ধের বইটা ভালো। মুক্তিযুদ্ধের উপর কোনো বই পড়েছেন কি না সেটা মাঝে মাঝে ভাইভা বোর্ডে জিজ্ঞেস করা হয়। আমি পড়েছিলাম “আমি বিজয় দেখেছি” বইটি। লেখক এম. আর. আখতার মুকুল। আপনিও একটি বই পড়ে রাখুন এতে আপনাকে নিয়ে পজিটিভ ধারণা হবে।
#সব প্রশ্নের উত্তর পারতে হবে এমন কোনো কথা নেই
১. আমার এক কলেজ ফ্রেন্ড। ৩৭তম বিসিএস ভাইভা বোর্ডে তার পারফরমেন্স ছিল খুবই খারাপ কারণ বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর পারছিল না। বোর্ড মেম্বারগণ খুবই বিরক্ত। রীতিমত ধমক দিয়ে বের করে দিয়েছেন।তবে ফলাফল ভাইভা পাস এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হিসাবে সুপারিশপ্রাপ্ত।
২. ১১তম জুডিশিয়ারি ভাইভা। নিজের ডিপার্টমেন্টের প্রশ্নের উত্তর ভালোই পারা যাচ্ছে। একজন বোর্ড মেম্বার প্রশ্নের করলেন ফারাক্কা ব্রিজ কী? প্রশ্ন শুনে আমার ফ্রেন্ড অবাক; তার মাথা একদমই কাজ করছিল না তখন। সরি বলল। এরপর জিজ্ঞেস করা হলো গঙ্গা পানি চুক্তি কী? উল্লেখ্য সেদিন ডিসেম্বরের ১২ তারিখ অর্থাৎ গঙ্গা চুক্তি দিবস ছিল। এই প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারল না। বোর্ডে ছিল ৭-৮ জন। তাদের কেউ কেউ হেসে উঠলেন আর একজন বললেন আপনার তো outside knowledge নাই । বোর্ডে যথেষ্ট লজ্জার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তবে কোন বেয়াদবি করেনি। মনে আসছে না, আগে পারতাম, এখন পারছি না এমন কোনো অজুহাত দেখায়নি। এটাই ছিল বোর্ডের শেষ প্রশ্ন।ফলাফল : সহকারী জজ/জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে সুপারিশপ্রাপ্ত।
এরকম আরও উদাহরণ দেওয়া যাবে। এখন থেকেই মনে হয় এটা,আগে পারতাম কিন্তু এখন মনে আসছে না ইত্যাদি অজুহাত, সস্তা কথা বলার অভ্যাস পরিত্যাগ করুন।
# সদা সত্য কথা বলুন Honesty is the best policy
১১ গ্রেডে চাকরি করা এক প্রার্থীর ধারণা তিনি যদি ভাইভা বোর্ডে বলেন তিনি কোনো চাকরি করছেন না তাহলে সেটা তার ক্যাডার প্রাপ্তিতে বিশাল ভূমিকা রাখবে। ভুলেও এই জাতীয় মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না। যারা ভাইভা বোর্ডে বসেন, তারা অনেক অভিজ্ঞ ও দক্ষ। আপনার চাতুর্য তাদের কাছে ধরা পড়ার ব্যাপক আশংকা রয়েছে। এই ছেলেটির ক্ষেত্রেও সেটি হয়েছে। যেহেতু অনেক আগে পাস করেছেন তাই এত দিন কী করছেন এই জাতীয় প্রশ্ন তিনি ঠিকভাবে ডিফেন্ড করতে পারেননি। আগে থেকে প্ল্যান করেছিলেন গান শেখাই এই উত্তর দিবেন কিন্তু ভাইভা বোর্ডে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান, বিভিন্ন গানের ধরন ইত্যাদি প্রশ্ন করায় তিনি তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। মিথ্যাবাদীকে কেউ পছন্দ করেন না। ভুলেও এই অপচেষ্টা করবেন না। এটা থেকে ১০০ হাত দূরে থাকুন। আর চাকরি পাওয়াটা গুণ। এটা আপনার যোগ্যতাকে আরও ফুটিয়ে তুলতে সহায়তা করবে। এটা নিয়ে লুকোচুরি করা বোকামির নামান্তর।
# ইংরাজিতে দক্ষতা বৃদ্ধির উপায়
বিসিএস ভাইভা প্রিপারেশনের জন্য ইংরেজিতে দক্ষতা শাণিত করা প্রয়োজন তবে আপনাকে আমেরিকা বা কানাডা বা ব্রিটিশ প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীদের মতো পারদর্শী হতে হবে না। আপনি যতটুকু পারেন সেটা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ুন। নিয়মিত অনুশীলন করুন। কোনো ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলুন। কেউ না থাকলে মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করুন, দেখুন কেমন হয়েছে। আয়নাতে দেখতে পারেন। প্রয়োজনে কোচিং সেন্টারে বা বন্ধুদের কাছে মক ভাইভা দিন। পরিবর্তন আসতে বাধ্য। মক ভাইভা শুধু ইংরেজি না আসল ভাইভার মতো সব বিষয় নিয়ে দিন।
# বিসিএস ভাইভাকে সহজভাবে নিন
বিসিএস ভাইভাতে ফেল করা খুব কঠিন। আপনি চরম বেয়াদবি বা বোকামি না করলে ফেল করবেন না। মাথা ঠান্ডা রাখুন। ৮০% প্রশ্নের উত্তর না পারলেও আপনি ভালো নম্বর পেতে পারেন। যেই প্রশ্নগুলো আপনি পারেন না সেগুলো কতটা বিনয় এবং স্মার্টনেসের সাথে উত্তর দিচ্ছেন সেটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মূলত এগুলো BCS viva preparation এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সবার আগে এগুলো কনফার্ম করুন তারপর অন্য বিষয়। এর সাথে অবশ্যই রেগুলার পেপার পড়বেন। চোখ-কান খোলা রাখবেন। বিসিএস ফরেন ক্যাডার প্রথম চয়েজ হলে সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক খুব ভালোভাবে পড়ুন।